দেশে প্রসাধনীর বাজার প্রায় ৩৪ হাজার কোটি টাকার। এর মধ্যে প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকার প্রসাধনী আমদানি হয়। বাকি ২৪ হাজার কোটি টাকার প্রসাধনীর বাজার চোরাকারবারি ও নকল পণ্য উৎপাদনকারীদের দখলে। এমনকি আমদানি ও উৎপাদিত প্রসাধনীর ৭০ শতাংশই থাকে মান নিয়ন্ত্রণের বাইরে। ফলে নকল ও মানহীন প্রসাধনী ব্যবহার করে দেশের মানুষ নানা জটিল রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। আবার চোরাই পথে বিপুল পরিমাণ প্রসাধনী দেশে আসায় সরকার আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। দেশে ওষুধ ও কসমেটিকস আইন প্রণয়ন হলেও নিয়ন্ত্রণহীনভাবে চলছে প্রসাধনীর এ বিশাল বাজার।সংশ্লিষ্টরা বলছেন, শপিংমলগুলোতে সাজানো দেশি-বিদেশি কসমেটিকসের কোনটি আসল আর কোনটি নকল, তা নিশ্চিত করা কঠিন। বিদেশি কসমেটিকসের দাপটে দেশীয় কসমেটিকস একপ্রকার কোণঠাসা। বাহারি গেট-আপ, উন্নত মোড়ক, প্যাকেট এবং বিজ্ঞাপনের তোড়ে দেশীয় কসমেটিকস শিল্প এখন অস্তিত্ব সংকটে। হাতেগোনা কয়েকটি দেশীয় কোম্পানির পণ্য বাজারে থাকলেও বেশিরভাগ কসমেটিকস ফ্রান্স, তুরস্ক, ভারত, সিঙ্গাপুর, দুবাই, ইউরোপিয়ান ইউনিয়নসহ অন্যান্য দেশ থেকে বাংলাদেশে আসে। বিদেশি কসমেটিকস বৈধপথে আমদানির চেয়ে চোরাই পথে ‘লাগেজ পার্টির’ মাধ্যমেই দেশের বাজারে প্রবেশ করছে বেশি। এ ছাড়া প্রসাধনী উৎপাদনের কাঁচামালের ৯০ শতাংশই আমদানিনির্ভর। বিশেষ করে মোট আমদানি করা প্রসাধনী পণ্যের প্রায় ৪১ শতাংশই ভারত থেকে আসে।ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশনের প্রতিবেদন অনুসারে, দেশে কসমেটিকস খাতের প্রায় ৩৪ হাজার কোটি টাকার বাজার রয়েছে। এর মধ্যে ২৪ হাজার কোটি টাকার প্রসাধনীর বাজার চোরাকারবারিদের দখলে। এর বাইরেও নকল, ভেজাল ও নিম্নমানের কসমেটিকসের দখলে রয়েছে বিরাট অংশ। নকল, ভেজাল ও নিম্নমানের কসমেটিকস ব্যবহারে মাথার চুল পড়ে যাওয়া, ফর্সা হতে গিয়ে চামড়া বিকৃত হওয়া, বন্ধ্যত্বসহ লিভার ও কিডনির নানা জটিল রোগে আক্রান্ত হওয়ার মতো ঘটনা ঘটছে।
এ প্রসঙ্গে ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তরের সাবেক উপপরিচালক ও আইন কর্মকর্তা মো. নুরুল আলম বলেন, প্রসাধনী সামগ্রী সরাসরি স্বাস্থ্যের সঙ্গে সম্পর্কিত হওয়ায় যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া, জাপান, ভারতসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশের ড্রাগ নিয়ন্ত্রক সংস্থা তথা ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তর নিয়ন্ত্রণ করে। তাই সরকার ওষুধ আইন-১৯৪০ রদ করে ওষুধ ও কসমেটিকস আইন-২০২৩ প্রণয়ন করে। আইনটি প্রণয়নের ক্ষেত্রে বিভিন্ন সময়ে অংশীজনের মতামত নেওয়া হয়। ওষুধ ও কসমেটিকস আইন-২০২৩-এর ২(৮) ধারায় প্রসাধনীর সংজ্ঞা এবং পঞ্চম অধ্যায়ের ৩১-৩৫ ধারায় প্রসাধনীর উৎপাদন, মান নিয়ন্ত্রণ, লাইসেন্স, নিবন্ধন এবং বিজ্ঞাপন সম্পর্কে বিশদ বিবরণ রয়েছে। আইনটিতে নকল-ভেজাল কসমেটিকস উৎপাদন ও বাজারজাতকারীদের পাঁচ বছরের কারাদণ্ডসহ ৫ লাখ টাকা জরিমানার বিধান রয়েছে।
তিনি বলেন, এরই মধ্যে আইনটি পাস হওয়ার এক বছর অতিক্রান্ত হলেও স্বাস্থ্যঝুঁকিতে থাকা দেশের বিরাট জনগোষ্ঠীকে রক্ষা করতে আইনের কার্যকর প্রয়োগ পরিলক্ষিত হয়নি। এমনকি নকল-ভেজাল কসমেটিকস উৎপাদন, চোরাকারবারিদের বিরুদ্ধে অভিযান, গ্রেপ্তার, মামলা বা জরিমানাসহ দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করা যায়নি। ফলে নকল-ভেজাল ও চোরাকারবারিদের দৌরাত্ম্য বাড়ছে। পরিস্থিতি উত্তরণে ওষুধ ও কসমেটিকস আইনের যথাযথ প্রয়োগ প্রয়োজন।
এ প্রসঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ওষুধ প্রযুক্তি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. এ কে লুৎফুল কবীর বলেন, আমরা চর্মরোগের যে ওষুধ তৈরি করি, সেটি ত্বকের মাধ্যমে শরীরের সিসটেমিটিক সার্কুলেশনে অর্থাৎ রক্তের মাধ্যমে সব অর্গানে পৌঁছে যায়। প্রসাধনীও ঠিক একইভাবে বিভিন্ন অর্গানে পৌঁছে যায়। অর্থাৎ নকল, ভেজাল বা নামহীন প্রসাধনী ব্যবহারের ফলে সেটিও একই প্রক্রিয়ায় ত্বক এবং শরীরের অন্যান্য অর্গান ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে। এমনকি কিডনি বিকল ও ক্যান্সার পর্যন্ত হতে পারে। তাই দেশের মানুষের স্বাস্থ্যগত নিরাপত্তায় ওষুধ ও কসমেটিকস আইন কার্যকর করতে হবে। ঔষধ প্রশাসনের লোকবল বাড়াতে হবে, প্রয়োজনে প্রসাধনীর উৎপাদন, বিপণন, সংরক্ষণ, মান নিয়ন্ত্রণ ও মূল্য নির্ধারণে আলাদা উইং গঠন করতে হবে।